রিপোর্ট রূপান্তর বাংলা — ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের একটি প্রস্তাব বা রূপরেখা তৈরি করেছে বিএনপি। প্রস্তাবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একসঙ্গে আন্দোলন, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের আমূল সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
জোট গঠনের ক্ষেত্রে কতগুলো কর্মসূচির ভিত্তিতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধারণত একমত হতে হয়। সাত দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য নিয়ে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর ঘোষিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চারদলীয় জোট গঠনে একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকার ছিল। চার দল পরে ২০ দলে পরিণত হয়। এগুলোর সঙ্গে বাম দলগুলোকে কাছে টেনে বিএনপি এখন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চায়।
তবে মূলত বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে এখনো জামায়াতে ইসলামী থাকায় বৃহত্তর ঐক্য গঠনে জোরালো তৎপরতা শুরু করতে পারছে না দলটি। কারণ উদার ও বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলো জামায়াত থাকতে আলোচনা শুরু করতেই রাজি নয় বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান সাংবাদিক কে বলেন, ‘বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এখনো পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকলে আলোচনার তো প্রশ্নই ওঠে না।’
অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, বৃহত্তর ঐক্য গঠনে কাজ চলছে। সিঙ্গাপুর থেকে টেলিফোনে তিনি সাংবাদিক কে বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কতগুলো কর্মসূচির প্রশ্নে আমরা প্রায় কাছাকাছি। কারণ উদার ও প্রগতিশীল দলগুলোও দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মেরুকরণে কী হবে জানি না। তবে জামায়াত এখনো ২০ দলীয় জোটে আছে।’
২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বিদায় করার প্রশ্নে গত কয়েক মাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা অনেক দূর এগোলেও এখন তা থেমে গেছে। কারণ এ প্রশ্নে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা এখনো পাওয়া যায়নি বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে। এর ফলে দলটির শীর্ষপর্যায়ের নেতারাই এখন বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। আর দলের যেসব নেতা জামায়াতের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, তাঁরা পড়েছেন হতাশায়। কারণ ওই নেতারা মনে করেন, জামায়াতকে না ছাড়লে দেশের প্রগতিশীল বলে পরিচিত দলগুলো বৃহত্তর ঐক্যে শামিল হবে না। তা ছাড়া ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থনও পাওয়া যাবে না বলে তাঁরা মনে করেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, খালেদা ও তারেক উভয়ই জামায়াতের বিষয়টি নিষ্পত্তির প্রশ্নে দোটানায় আছেন। তাঁরা মনে করেন, দেশের পরিস্থিতি কখন কোন দিকে মোড় নেয় তার ঠিক নেই। তা ছাড়া জামায়াত চলে গেলে তার ফলাফল কী দাঁড়ায় এ নিয়েও তাঁরা হিসাব মেলাতে পারছেন না বলে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে। আবার ছেড়ে দিলে জামায়াতকে নিয়ে সরকার ‘রাজনীতি’ করবে এমন আলোচনাও আছে তাঁদের মধ্যে।
দলের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আলোচনার সূত্র ধরে গত এক বছরে জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। এ ছাড়া কৌশলগত কারণে জামায়াতকে দূরে রাখার পক্ষে মত আছে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আরো কয়েক নেতার। দলের বেশির ভাগ নেতার এমন মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সাম্প্রতিককালে আলোচনায় গতি পায়। এমন পরিস্থিতিতে কিছুদিন আগে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় দলের নীতিনির্ধারক এক নেতাকে। তবে ওই আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ২০ দলীয় জোটের একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় গত ১৪ জানুয়ারি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে ওই সভায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘স্বাধীনতার স্থপতি’ বলে উল্লেখ করেন। ওই দিনের অনুষ্ঠান নিয়ে বিএনপির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। তবে সবাই ধরে নেন যে তারেক রহমানের সম্মতি নিয়েই নজরুল ইসলাম খান ওই অনুষ্ঠানে গেছেন। এই বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করলেও নজরুল ইসলাম খান ফোন ধরেননি।
২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বামপন্থী দলগুলো যুক্ত হলেই বৃহত্তর জোট গঠন সম্ভব বলে মনে করে বিএনপি। এ লক্ষ্যে ওই দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা কয়েক বছর ধরেই করে যাচ্ছে দলটি। কিন্তু আলোচনা শুরু করতে গেলেই তারা প্রথমত জামায়াতের কথা তোলে। দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ ইঙ্গিত করে তারেক রহমানের নেতৃত্বের দিকে। তবে সরকারবিরোধী মনোভাব আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় তারেকের নেতৃত্বের ‘বাস্তবতার’ বিষয়টি বিএনপি ওই সব দলের নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে। তাঁরা বলছেন, তারেক রহমান এখনই দেশে আসছেন না। তা ছাড়া তারেক ‘বদলেছেন’ এমন যুক্তিও তাঁরা দিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, এমন অবস্থার মধ্যেই কী কী কর্মসূচির ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য হতে পারে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দফায় দফায় আলোচনা করে তারই একটি প্রস্তাব তৈরি করে বিএনপি।
সূত্র জানায়, ওই প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার পর সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তা উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আলোচনায় নেতারা বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকতে ঐক্যের চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। তা ছাড়া তারেক রহমান নীরব থাকায় ওই বিষয়ে আর কেউ কথা তুলছেন না।
জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সাংবাদিক কে বলেন, ‘বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিঙ্গাপুর থেকে ফিরলে বৃহত্তর ঐক্যে অগ্রগতি হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সবার লক্ষ্য হয়ে থাকলে সেখানে ছোট-খাটো বিষয়গুলো বাদ দেওয়া উচিত।’ তাঁর মতে, ‘এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে ছিল। এখনো যুগপৎ হলে অসুবিধা কোথায়?’
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দাবি করেন, বৃহত্তর ঐক্য হবে। তবে চূড়ান্ত রূপ নিতে একটু সময় লাগছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান দাবি করেন, ‘বৃহত্তর ঐক্যের উদ্যোগ থেমে যায়নি। এ ব্যাপারে কাজ চলছে।’ তিনি বলেন, ‘যেকোনো ঐক্য গড়ে তুলতে সময়ের প্রয়োজন হয়।’
কী আছে প্রস্তাবে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য একসঙ্গে জোট গঠন তথা সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা বলা আছে বিএনপির প্রস্তাবে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দল ও সমাজের অপরাপর অংশের মতামত নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে এতে। প্রস্তাবে এ জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনের কথাও বলা হয়েছে।
বিএনপির প্রস্তাবে খালেদা জিয়ার মুক্তির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি প্রথমে উল্লেখ থাকলেও পরে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মক্ষম সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়োগবিধি প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিয়ে এই আইনি বিধি-বিধানের আলোকে নতুন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে হবে।
প্রস্তাবে নির্বাচনকালীন নির্বাচনসংক্রান্ত সব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাধীন থাকা, কমিশনের নিজস্ব লোকবল থেকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া, রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং অফিসার এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে।
জানা গেছে, ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট বাম গণতান্ত্রিক জোটের ঘোষিত প্রস্তাবের সঙ্গে সমন্বয় করে বিএনপির প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, সরকারের পদত্যাগ, সবার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন এবং নির্বাচন কমিশনের আমূল সংস্কারের প্রস্তাব বাম দলগুলোর ঘোষিত প্রস্তাবেও ছিল। আলোচনা শুরু হলে দুই প্রস্তাবের সমন্বয় করে বৃহত্তর ঐক্যের কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।