অনলাইন ডেক্স : রায়েরবাজার বধ্যভূমি সংলগ্ন কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকে প্রথম দাফন করা হয় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা রাজধানীর কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা হাজী মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনকে। কবরস্থানের মোট ১৬টি ব্লকের মধ্যে এ ব্লকটি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাকি ১৫টি ব্লকের মধ্যে ৮ নম্বর ব্লকটি অনেকটাই ব্যতিক্রম।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে ২০১৬ সালে দেশের বৃহত্তম এ কবরস্থানের যাত্রা শুরু হয়। শুরুর পর থেকে যেখানে বাকি ১৫টি ব্লকের অনেকগুলোই এখনও খালি পড়ে আছে, সেখানে মাত্র আটমাসের মধ্যে ৮ নম্বর ব্লকে হু হু করে বেড়েছে কবরের সংখ্যা। করোনার ভয়াল থাবায় একের পর কবরের সারিতে মাটি চাপা পড়েছে প্রিয়জনের মুখ।
এই ব্লকে কবরের সংখ্যা নেহায়েত একশো-দুইশো নয় বরং ছাড়িয়েছে হাজারের ঘর। বুধবার (২৮ এপ্রিল) দুপুর পর্যন্ত কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মোট এক হাজার ২১০ জনকে দাফন করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৫১ জন করোনায় মৃত ব্যক্তিকে এখানে কবরস্থ হয়েছেন।
বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেন রায়েরবাজার কবরস্থানের সিনিয়র মোহরার আব্দুল আজিজ। তিনি বলেন, ঢাকায় করোনার সংক্রমণে মৃত ব্যক্তিদের দাফনের জন্য প্রথমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এর খিলগাঁও তালতলা কবরস্থান ব্যবহৃত হলেও পরবর্তীতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এখানে (রায়েরবাজার কবরস্থানে) ৮ নম্বর ব্লকে দাফন কার্যক্রম শুরু হয়। এই বছরের শুরুর তিনমাস সংক্রমণে মৃত মানুষের সংখ্যা কম হলেও এপ্রিল মাস জুড়ে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই ১০ থেকে ১৫ টি করে মরদেহ দাফন করতে হয়েছে। গোরখোদকরা কবর খুঁড়ে খুঁড়ে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় এক্সকাভেটর ব্যবহার করে কবর খনন করতে হয়েছে। এখনও আগে থেকেই ১০টির মতো কবর খনন করে রাখা হয়। কখন একসঙ্গে অতিরিক্ত মরদেহ চলে আসে, তা আমরা বলতে পারি না।
আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য যে, করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফন করার পরও কবরস্থানের ২৮জন গোরখোদকদের কেউই এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হননি। যেখানে করোনা পরিস্থিতি শুরুর দিকে সংক্রমণের ভয়ে স্বজনরাও মরদেহের সঙ্গে কবরস্থানে আসতে ভয় পেতেন, সেখানে পরম যত্নে মৃত ব্যক্তিদের দাফন কার্য সম্পন্ন করতে পিছপা হননি এ গোরখোদকরা।
কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লক ঘুরে দেখা যায়, এখনও পশ্চিম পাশে খনন করে রাখা হয়েছে প্রায় ১০টি নতুন কবর। সকাল থেকে দাফন করা হয়েছে আরও দশজনকে। গত কয়েক দিনের মত এতো মৃতদেহ একসঙ্গে কখনও দাফন করতে হয়নি গোরখোদকদেরও। এমন অবস্থায় অনেকটাই ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথাও জানালেন অনেকে।
কবর পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত কামাল হোসেন বলেন, এই ফাঁকা ব্লকটা চোখের সামনেই কেমন করে যেন ভরে গেল। এখানে এতদিন ধরে কাজ করি। তবুও একসঙ্গে এত লাশ দাফন হতে দেখিনি। প্রথমদিকে ভয়ের কারণে লাশের সঙ্গে স্বজনরাও আসতেন না। তারপরও আমাদের এখানকার কেউ কখনোই লাশ দাফনে কোনো আপত্তি করেননি।
কবরস্থানের প্রধান গোরখোদক লিয়াকত আলী বলেন, করোনায় আমাদের ভিন্নরকম এক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাফনে কাজ করছি। কেউ এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হইনি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এখানে দাফন কাজ চলে। এখন তো স্বজনরাই মরদেহ নিয়ে আসেন। কিন্তু প্রথমদিকে শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবী এবং আমরা মিলেই দাফন করেছি।
আরেক গোরখোদক শফিকুল ইসলাম বলেন, করোনা সংক্রমণের আগে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়টি সর্বোচ্চ ১০টি লাশ দাফনের জন্য আসতো। কিন্তু এখন আগে থেকেই প্রায় ১৫ থেকে ২০টি কবর রেডি রাখা হচ্ছে।
মূলত করোনার সংক্রমণে প্রাণহানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে চাপ বেড়েছে বলেই আগে থেকেই কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুল হাই তালুকদার। তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় ছয়টি কবরস্থান রয়েছে। এর মধ্যে রায়েরবাজার বধ্যভূমি সংলগ্ন কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফন করা হচ্ছে।
এছাড়াও দাফনের জন্য মরদেহ নিয়ে আসা স্বজনদের যেন বেশি সময় কবরস্থানে অপেক্ষা করতে না হয় এবং নতুন করে যেন কোনো সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি না হয় সেজন্য দ্রুত কাজ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।