ময়মনসিংহ থেকে সিরাজুল হক সরকার: কৃষকের যন্ত্র নরসুন্দরের নামে। কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই। কাগজে নাম থাকলেও বাস্তবে পায়নি। এমনই ঘটনা ঘটেছে মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি অফিসে ভর্তুকিতে বোরো মৌসুমে ধান মাড়াইকল বিতরণে।
জানাযায়, মুক্তাগাছায় খামার যান্ত্রিকিকরণের মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিকীকরনের জন্য চলতি বোরো মৌসুমে ধান মাড়াইকল (পাওয়ার থ্রেসার) ভর্তুকি মূল্যে বিক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি অফিসারের বিরুদ্ধে। ভর্তুকি মূল্যের কৃষিযন্ত্র গুলো কাগজে-কলমে বিক্রি করে সরকার প্রদত্ত ভর্তুকির টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কৃষিযন্ত্র না নিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকার ভাগ পেয়েছেন সুবিধাভোগীরা। এ নিয়ে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও উপজেলার সচেতন নাগরিকদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিতরণের ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীর তালিকায় প্রকৃত কৃষকের পরিবর্তে নরসুন্দর, অটোচালকসহ অন্যান্য পেশার মানুষের নাম রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে কোম্পানীর যন্ত্র দোকানেই রয়েগেছে, কমিশন ভাগের মাধ্যমে কাগজে কলমে বিতরণ দেখানো হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানাযায়, চলতি বোরো মৌসুমে সরকার কর্তৃক খামার যান্ত্রিকীকরণ এর ব্যবহার বৃদ্ধি ও কৃষিকে আধুনিকায়নের জন্য ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণের লক্ষ্যে ফসল কাটার ২/৩ মাস পূর্বে উপজেলার আগ্রহী কৃষকদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহবান করেন উপজেলা কৃষি অফিসার সেলিনা পারভিন। উপ-সহকারী কৃষি অফিসারদের অবগত না করে তিনি নিজে বিতরণের চ‚ড়ান্ত তালিকা তৈরি করেন। যন্ত্র গুলো বিতরণে শনাক্তকারী হিসেবে সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকার কথা থাকলেও এব্যাপারে তারা কিছু জানেন না। এ অনিয়মে সার্বিক সহযোগিতা করেছে তার অফিসের নৈশ প্রহরী সোহাগ মিয়া। যন্ত্র গুলো বিতরণে স্বাক্ষী হিসেবে তাকে রাখা হয়েছে বলে জানাযায়।
চলতি বোরো মৌসুমে ভর্তুকির আওতায় ধান মাড়াই কল বা পাওয়ার থ্রেসার গুলোর দাম দেড় লাখ টাকার মধ্যে। প্রতি মেশিনে সরকার ৫০% ভতুকি দিয়ে সুবিধা ভোগীদের কাছে বিতরণ করছে। কৃষি অফিসের তথ্যমতে চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১৭টি মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। যার আনুমানিক মল্য ২৫ লক্ষ টাকার উপরে। সরকার প্রদত্ত অধিকাংশ ধানমাড়াইকল বা পাওয়ার থ্রেসার গুলো কাগজে-কলমে বিক্রি করেন উপজেলা কৃষি অফিসার। ভর্তুকি টাকার কিছু অংশ সুবিধা ভোগীদের হাতে দিয়ে তাদের কাছ থেকে ৩শ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর ও মেশিনের সাথে একটি ছবি তুলে রাখেন তাদের। প্রকল্পের তথ্যমতে মেশিন গুলো বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করার কথা থাকলেও কোথাও আপন চাচা-ভাতিজা, একই বাড়ি বা নিকটতম প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। মৌসুম শুরুর আগে মেশিন গুলো বিতরণ করার কথা থাকলেও তিনি সুকৌশলে মৌসুম শেষে ধীরে ধীরে মেশিন গুলো বিতরণ করছেন যাতে বিষয়টি প্রকাশ্যে না আসে।
এব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা হলে তারা জানান, বোরো ফসল কাটার আগে স্থানীয় কৃষকদের কাছে ধান মাড়াইকল বা পাওয়ার থ্রেসার ভর্তুকি মূল্যে বিক্রয়ের জন্য অফিস কর্তৃক নির্দেশনা রয়েছে প্রকল্প পরিচলাকের চিঠিতে। কৃষি অফিসার সেই চিঠি গোপন রেখে আমাদের অবগত না করে বোরো মৌসুম শেষে মেশিন গুলো তার সুবিধামতো লোকজনের কাছে বিতরণ করেছেন। তারা জানান, আমরা সবসময় মাঠে কৃষকদের সাথে কাজ করি। কাদেরকে মেশিনগুলো দিলে স্থানীয় কৃষকরা বেশি উপকৃত হবে তা আমরা জানি। তিনি এসকল বিষয়ে আমাদের সাথে পরামর্শন না করে অন্যপেশার লোকদের কাছে মেশিন গুলো বিক্রি করায় প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে জানাযায়, উপজেলার খেরুয়াজানী ইউনিয়নের বানিয়াবাড়ী, মহেশবাড়ী গ্রামে চলতি মৌসুমে ভর্তুকি মূল্যে পাওয়ার থ্রেসার গ্রহনকারী রামভদ্রপুর কালিবাড়ী বাজারের নরসুন্দর জামান মিয়া ও তার আপন চাচা ইব্রাহিমের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা সেলুনে কাজ করে সংসার চালাই। বাজারের ব্যবসায়ী আজিজুল ইসলাম ভাই আমাদের এনআইডি ও ছবি দিতে বলল, দিলাম। পরে উপজেলা অফিসে গিয়ে স্বাক্ষর করে আসলাম। মেশিনের জন্য টাকা তারা দিয়েছে, মেশিনও তারা এনেছে। এসময় মেশিন দেখতে চাইলে নরসুন্দর জামান কাওছার মিয়ার দোকানের সামনে ইঞ্জিন বিহীন একটি মেশিন দেখালেও ইব্রাহিমের মেশিনের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এব্যাপারে সুবিধাভোগী ঘোষবাড়ী গ্রামের আবু রায়হানের সাথে কথা হলে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বোরো মৌসুম শুরুর আগে একটি ধান মাড়াইকলের জন্য আবেদন করেছিলাম কৃষি অফিসে। মৌসুমের আগে মেশিনটা পেলে কয়টা টাকা রোজগার করতে পারতাম। মৌসুম শেষে অফিস থেকে আমাকে মেশিন নেওয়ার জন্য ফোন করে। মৌসুম শেষ এখন মেশিন নিয়ে কি করব, আগামি মৌসুমে মেশিন নেব? পরে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর রেখে মিষ্টি খাওয়ার জন্য কিছু টাকা কৃষি অফিসার দেন বলে তিনি জানান।
কুমরাগাতা ইউনিয়নের সোনাপুর, শ্যামপুর ও ঘোষবাড়ী গ্রামের মোতালেব, হারুন অর রশিদসহ অন্যদের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা ভর্তুকি মূল্যে পাওয়ার থ্রেসার উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কিনে এনেছি। এসময় মেশিন গুলো দেখতে চাইলে তারা দেখাতে পারেনি। তারা বলেন মেশিন আছে, বোনের বাড়িতে রেখে এসেছি, মেশিন ঠিক করতে কোম্পানীতে পাঠাইছি, কেউ বলে পাশের গ্রামে ধান মাড়াই করতে নিয়ে গেছে। যন্ত্রক্রয়ের কোন কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি। এখনতো বোরো মৌসুম শেষ, কোথায় ধান মাড়াই করেন জিজ্ঞাসা করলে তারা কোন উত্তর দিতে পারেনি। অনেকে সাংবাদিকদের পরিচয় পেয়ে সাক্ষাত না করে কেটে পড়ে।
এব্যাপারে স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা পুরাতান মেশিন দিয়ে অতি কষ্টে ধান মাড়াই করেছি। নতুন মেশিন কিনলে কিনতে পারে আমরা দেখি নাই।
অফিসের নৈশ প্রহরী সোহাগ মিয়া জানান, আমি ছোট চাকুরি করি এসব বিষয়ে কিছু জানিনা। আমার অফিসার কোথাও স্বাক্ষর করতে বললে তো তার কথা আমাকে রাখতে হয়।
এব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিসার সেলিনা পারভিনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, চলিত বোরো মৌসুমে উপজেলায় ভর্তুকির আওতায় ১৭জন কৃষকের মাঝে ধান মাড়াইকল বা পাওয়ার থ্রেসার বিতরণ করা হয়েছে। কৃষককে মেশিন না দিয়ে টাকা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি কোন কৃষককে টাকা দেইনি। মেশিনগুলো কৃষকদের মাঝে বিতরণ করেছি। এতে কেউ অনিয়ম করলে তদন্তকরে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।