গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই বলেই সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, মুক্ত সাংবাদিকতা চরম সঙ্কটে

ময়মনসিংহ থেকে সিরাজুল হক সরকার
সাংবাদিক ইউনিয়ন ময়মনসিংহ-জেইউএম’র বার্ষিক সাধারণ সভায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র নেতৃবৃন্দ বলেছেন, মুক্ত পরিবেশ ছাড়া মুক্ত সাংবাদিকতা করা যায় না। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই বলেই আজ সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মুক্ত সাংবাদিকতা এখন চরম সঙ্কটে। এ সরকারের আমলে সাগর-রুনিসহ ৬০জন সাংবাদিক খুন হওয়ার কথা উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, সাংবাদিক হত্যার কোনো বিচার হচ্ছে না। ১০৮ বার সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন পিছিয়েছে। চার শতাধিক গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ ৪২ ধাপ পিছিয়েছে।

সম্পাদক মাহফুজ আনাম- মতিউর রহমানসহ কেউ রেহাই পাচ্ছেনা সরকারি নিপীড়ন থেকে। শুধু সাংবাদিক নয় গণতন্ত্রকামী সব মানুষকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধপ্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় এসেছে।
গতকাল শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) সকালে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সাংবাদিক ইউনিয়ন ময়মনসিংহ-জেইউএম’র সভাপতি আইয়ুব আলীর সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামের সঞ্চালনায় বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ও প্রধান বক্তা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী এসব কথা বলেন।

বক্তব্য রাখেন বিএফইউজে’র সাংগঠনিক সম্পাদক এরফানুল হক নাহিদ, দপ্তর সম্পাদক আবু বকর, নির্বাহী সদস্য হামিদুল হক মানিক, জেইউএম’র যুগ্ম-সম্পাদক আমান উল্লাহ আকন্দ জাহাঙ্গীর। কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন জেইউএম’র সদস্য খালেদ আহমদ শামসুল আলম পনির।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএফইউজে’র সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভয়াবহ সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। গণমাধ্যমের টুঁটি এমনভাবে চেপে ধরা হয়েছে যে এর স্বাধীনতা এখন পুরোপুরি বিপন্ন। দু:শাসন পাকাপোক্ত করতে গণমাধ্যমকে হুমকি, ভয় প্রদর্শন, সাংবাদিক হত্যা, গ্রেফতার, নির্যাতন চলছেই। কথায় কথায় গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

সাংবাদিকদের জেলে ঢুকানো হচ্ছে। গণমাধ্যম শিল্পে ভয়ের সংস্কৃতির কারণে সত্য তুলে ধরা হচ্ছে না। গণমাধ্যম দিন দিন আস্থা হারাচ্ছে। সাংবাদিক নির্যাতনের ভয়াবহতা তুলে ধরে রুহুল আমিন গাজী বলেন, স্মরণকালের ইতিহাসে মিডিয়া এবং মিডিয়া কর্মীদের এমন দুর্দিন আর কখনও দেখা যায়নি। গত ১৫ বছরে ৬০জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। জেলে ঢুকানো হয়েছে অনেক সাংবাদিককে। সত্য প্রকাশ করতে কিংবা পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে হামলা-মামলা ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু সাংবাদিক। এমনকি কখনও কখনও প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হচ্ছে।

এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার হয়ে খোদ রাজধানীতে বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক আফতাব আহমেদ, সাংবাদিক দম্পতি ফরহাদ খাঁ-রহিমা বেগম, আবুল হাসান আসিফ, ফতেহ ওসমানি, শফিকুল ইসলাম টুটুল, মাহমুদ হাসান তারেক, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের সাংবাদিক আবদুল হাকিম,পাবনায় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সাংবাদিক সুবর্ণা আক্তার নদী, কুমিল্লায় আবুল কালাম আজাদ, নারায়নঞ্জে ইলিয়াস হোসেন, চুয়াডাঙ্গায় আবু সায়েম, সিলেটে রুহেল আহমেদ তালুকদার, নোয়াখালীতে বোরহান উদ্দিন মুজাক্কিরসহ বহু সাংবাদিক জীবন দিয়েছেন।

কিন্তু দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না। সাংবাদিক নির্যাতন-নিপীড়নের কোনো বিচার হয় না। ৬০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হলো অথচ কোনো সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। বিচারহীনতার কারণে এবং দেশে গণতন্ত্র নেই বলে সাংবাদিক নির্যাতন বাড়ছে।
বিএফইউজে মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম গণমাধ্যমের হতে পারছে না। সত্য তুলে ধরতে না পারায় সংবাদমাধ্যম দিন দিন মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। যা সংবাদমাধ্যমকে অস্তিত্বের সঙ্কটে ধাবিত করছে। গণমাধ্যম সব সময় জনগণের পক্ষে থাকার কথা। কিন্তু গণতন্ত্র না থাকলে গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতা থাকে না তা আমরা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি।

ফ্যাসিবাদি শাসনের কারণে সংবাদমাধ্যম গণমুখি সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের ভালো ও কল্যাণের পক্ষে থাকতে হবে। সাংবাদিকরা হবে সত্যপন্থি। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলবে। বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারহরণ, ভোটাধিকারহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ণ, শোষণ, অবিাচরের বিরুদ্ধে কথা বলবে সাংবাদিকরা। এজন্যই ‘গণমাধ্যম’ ও সাংবাদিকদের ভরসার শেষ ঠিকানা মনে করে সাধারণ মানুষ। সরকার নানা কালাকানুন তৈরি করে গণমধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করেছে। আজ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ততটুকুই আছে যতটুকু সরকারের পক্ষে যায়’।

তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে, অধিকাংশ মিডিয়ার মালিক হয় রাজনীতিক না হয় ব্যবসায়ী। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মিডিয়াকে ব্যবসায়িকভাবে টিকিয়ে রাখার কৌশলের অংশ হিসেবে বাক্স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক তথ্য অধিকার হরণকারী কালা কানুন মেনে চলার পথ বেছে নিয়েছেন এসব মালিকরা। মিডিয়াকে ব্যবসায়ীরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এখানে সরকারি দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রী, প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা কিংবা সচিবদের অপব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে, প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে, রাষ্ট্রীয় খরচের মডেল নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না। ফলে চুরি, লুণ্ঠন, জালিয়াতি, ঘুষ, তদবির, চাঁদাবাজিকেন্দ্রিক দুর্বৃত্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’র মৌলিক দায়বদ্ধতার বিষয় অনুপস্থিত। সমালোচনার সীমা রেখা এতোটা সীমিত করা হয়েছে যে, কিছু কিছু ব্যক্তির নাম মুখেও আনা যায় না।

আইন করে কোন কোন নেতার সমালোচনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে! ফলে সংবাদমাধ্যম ‘গণমানুষ’কে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না বরং প্রশাসনসহ ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দলের সার্বিক রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করছে। মালিকদের লিপ্সার কারণে সেলফ সেন্সরশিপের সংস্কৃতিতে মিডিয়াকর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সরকারের বিধিনিষেধের চাইতেও মালিকদের ‘দলদাস’ প্রবণতা গণমাধ্যমের চরিত্র নষ্ট করে ফেলছে।

সম্পাদকরা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে প্রশ্ন না করে তৈল মর্দনে ব্যস্ত থাকেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স এখন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, কিংবা সরকারের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের নয়। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নাগরি স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।