ময়মনসিংহ থেকে সিরাজুল হক সরকার: ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা মানেই কেএম খালিদ বাবু, মুক্তাগাছা মানেই বিল্লাল হোসেন সরকার ও তার জামাতা মাহাবুবুল আলম মনি এবং আরব আলী। গত ১৫ বৎসর মুক্তাগাছার ত্রাস জনমনের আতঙ্ক। মুক্তাগাছা আওয়ামীলীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্বে সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবু অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই আকন্দ। আব্দুল হাইকে কোণঠাসা করে রেখে একক ভাবে মুক্তাগাছার সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে কেএম খালিদ বাবু। এমন কোন জায়গা/সেক্টর নেই যেখানে খালিদ বিল্লালের হস্তক্ষেপের। ২০০৯ সালে ময়মনসিংহ সদর থেকে মুক্তাগাছায় এসে বিটিবির সংবাদ পাঠিকা মরহুমা রাশিদা মহিউদ্দিনের গড়া মাঠে তৃণমূল ভোটে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। মুক্তাগাছা আওয়ামীলীগের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। বিল্লাল হোসেনকে পক্ষে নিয়ে এমপির আসনে বসে একাধারে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ইউপি চেয়ারম্যান/ইউপি নেতা বানাতে মনোনয়ন বাণিজ্য সহ নানা অনিয়মের নিয়ন্ত্রণ নেন তার হাতে। আর এসব কাজে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন সরকার ও তার জামাতা মনি সহ খালিদ বাবুর নিজ আত্মীয় স্বজনদের।
স্থানীয়দের মতে সাবেক এমপি ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর অনিয়ম পুরোপুরি ব্যবসায়ী। নিজে মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে থেকে নিজস্ব আত্মীয় স্বজনকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিভিন্ন পদে বসিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য তদবির সহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে রাম রাজত্ব কায়েম করেন। বিভিন্ন সময় আওয়ামী বিরোধীদের মিথ্যা, গাড়ি পোড়া মামলা, কাল্পনিক বোমা হামলা সহ বিভিন্ন কাল্পনিক মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করেন। এতে কয়েক শত মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরীহ মানুষদের এলাকা ছাড়া করে রাখতেন। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে নির্বাচনের সময় দলীয় সিদ্ধান্তে কে এম খালিদ তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। বিনা ভোটে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির এমপি সালাহউদ্দিন আহমেদ মুক্তি। কিন্তু মুক্তি এমপি হলেও আওয়ামীলীগ সরকার থাকায় যাবতীয় প্রভাব খাটাতেন খালিদ ও বিল্লাল। বিল্লাল হোসেনের জামাতা মনি উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হয়ে উপজেলার সর্বত্র একটি সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে এবং তাদের মাধ্যমে অটোরিক্সা, সিএনজি সহ জমির দালালি, জবর দখল সহ সকল কর্মে রিং লিডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন। এমন কোন জায়গা নেই তাদের হাত থেকে কেউ রেহাই পেয়েছে।
বিল্লালের মেয়ে অর্থাৎ মনির স্ত্রী বিলকিস বেগম রাস্তার চাঁদা, দাদন ব্যবসা সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিতো। তাছাড়া বিল্লালের দুই ভাই হেলাল কমিশনার ও অন্য ভাই লিয়াকত আলী মনিরামবাড়ী সহ শহরের যে কোন জমি ক্রয়-বিক্রয় হলেই বিল্লাল ও তার ভাই দের দালালি বা কমিশন দিতে হতো। তাদের কমিশন ছাড়া জমি বিক্রি প্রায় অসম্ভব। এমনি ভাবে বিল্লাল হোসেন ও তার জামাতা মনির শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের সাথে তার ভাই বিল্লাল সহ অন্যরাও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
জামাতা মনি শহরের দরগাহ্পাড় এলাকার বাসিন্দা মৃত এলাহী মিস্ত্রী ওরফে টিউবওয়েল মিস্ত্রীর পুত্র। সাধারণ পরিবারের ছেলে মনি। বিল্লালের মেয়ে বিয়ে করার পর শ^শুরের প্রভাবে রাতারাতি যুবলীগের সভাপতি হয়ে মুক্তাগাছায় প্রথম মাদকের ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু করে। স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা শুভ দে এর নেতৃত্বে গড়ে তোলেন এক হেলমেট বাহিনী। শুভ দে ও জামান কে দিয়েই শহর ও বিভিন্ন এলাকার ত্রাস সৃষ্টি করে নিজেকে জানান দিতে।
নিয়োগ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি
উপজেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাইস্কুল, মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়োগ দিতে হলে খালিদ ও বিল্লাল হোসেন কে মোটা অঙ্কের কমিশন না দিলে নিয়োগ হতো না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তারি নিয়োগে কেএম খালিদ বাবু জনপ্রতি ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা নিতেন। উপজেলার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে তার মনোনীত/আত্মীয় স্বজন কে দেয়া হতো। যেসব স্কুলে/প্রতিষ্ঠানে তার লোক না থাকতো সেখানে প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে টাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। অন্যথায় প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করে তার অনুগত কোন সহকারী শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পাদন করে টাকা কামিয়ে নিতো। এ কাজে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন সরকারের মাধ্যমেই টাকা আদান-প্রদান হতো। প্রতিদিন রাতেই বিল্লালের বাস ভবনে নিয়োগের টাকা নিয়ে দর কষাকষি ছিল নিত্যকার ব্যপার। এভাবে শত কোটি টাকা কামিয়েছেন খালিদ, বিল্লাল।
মুক্তাগাছা প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের অর্থায়নে দরিচারিআনি বাজারে মার্কেট নির্মাণ করে। নির্মাণের বাস্তবায়নের দায়িত্ব পান পৌরসভা। কিন্তু মার্কেট বরাদ্দ কালে বিল্লাল হোসেন সরকার প্রতিটি দোকান থেকে ৫/৬ লাখ টাকা করে মোট আড়াই কোটি টাকারও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দোকানপ্রতি মাত্র ৫ হাজার টাকার রশিদ দেন। এছাড়াও বিদায়ের কয়েকদিন আগে পৌরসভায় ১১ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কোটি টাকা কামিয়েছেন।
সড়কে চাঁদাবাজি
মুক্তাগাছা শহরে এবং উপজেলার সকল ব্যাটারী চালিত/সিএনজি চালিত অটো রিক্সা চলাচল করতো সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করতো মাহাবুবুল আলম মনি। একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রকাশ্যে রাস্তায় চাঁদা আদায় করা হতো কিন্তু প্রশাসন থাকতো নিরব। মনিরের দক্ষিণ হস্ত জামান এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতো। খোজ নিয়ে জানা যায়, মুক্তাগাছায় প্রায় ৫ হাজার অটোরিক্সা ও সিএনজি চলাচল করে। এসব সিএনজি রাস্তায় নামানোর আগে রাস্তায় চলাচলের অনুমতি হিসেবে মনি কে দিতে হতো ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা। মনি’র নিজস্ব অটো ব্যবসা থেকে বাজার দরের চেয়ে ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হতো অটো রিক্সা। তার কাছ থেকে অটো না কিনলে সে অটোরিক্সা রাস্তায় চলাচল করতে পারতো না। চাঁদা বাবদ প্রতিমাসে প্রায় দেড় থেকে ২ কোটি টাকা আদায় করতো এ সিন্ডিকেট বাহিনীর মাধ্যমে।
মনোনয়ন বাণিজ্য ঃ
কে এম খালিদ (সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী) এর মনোনয়ন বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। মুক্তাগাছা উপজেলার কোন ইউপি চেয়ারম্যান/মেম্বার (ইউপি সদস্য) নির্বাচন করবেন তার নির্ধারণ করে দিতেন। তার ইশারা ছাড়া কেউ মনোনয়ন পেতেন না। নৌকার মনোনয়ন পেতে ইউপি চেয়ারম্যান পদে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত তাকে দিতে হতো। কে এম খালিদ এমপি ডান হাত হিসেবে ব্যবহার করেন সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আরব আলী, বিল্লাল হোসেন সরকার, জামাই মনি, মোয়াজ্জেম চেয়ারম্যান, সেলিম সরকার সহ আরো বেশ কয়েকজন। তবে কে এম খালিদের নাম ভাঙ্গিয়ে বিল্লাল হোসেন সরকার, মনির জমি দখল সহ শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন।
আরব আলী গরিবের জমি দখল করে মুক্তাগাছা হাসপাতাল গেইটে দ্বীতল সুপার মার্কেট করেছেন। অবৈধ পথে রোজগার করেছেন কোটি কোটি টাকা। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও তাদের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন মনি’র বিল্লাল গ্রুপ সহ ভাইস চেয়ারম্যান বিটুল ও তাদের পন্থী লোকজন। তবে মুক্তাগাছায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের প্রকট আন্দোলনের মুখে তেমন সুবিধা করতে পারেনি।