বর্তমানে “লিগ্যাল এইড আইন ২০২৫ (সংশোধিত)” নিয়ে দেশে নানা মহলে আলোচনা চলছে। একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে—দেওয়ানি কার্যবিধিতেই যখন আপোষের বিধান রয়েছে, তখন নতুন করে এই আইনের প্রয়োজন কেন?
আমার দীর্ঘ মাঠপর্যায়ের বিচারিক অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট করে বলতে পারি—আইন যত ভালো হোক না কেন, যদি তার কার্যকর প্রয়োগ না হয়, তবে তা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিচার ব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা, জনগণের ভোগান্তি এবং বিচারক হিসেবে আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি—বিচারপূর্ব আপোষ বাধ্যতামূলক করাই এখন সময়ের দাবি।
১. কাগজে-কলমে আপোষ, বাস্তবে অনুপস্থিত পক্ষগণ
আজ (৯ জুলাই ২০২৫) আমার আদালতে (সিনিয়র সহকারী জজ, সদর, সুনামগঞ্জ) অন্তত দুটি দেওয়ানি মামলায় আপোষ শুনানির দিন ধার্য ছিল। প্রতিটি মামলায় উভয় পক্ষ হাজিরা দাখিল করলেও আপোষ শুনানির সময়ে কেউই উপস্থিত ছিলেন না—এমনকি আদালতের লিখিত নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও! এটি ব্যতিক্রম নয়; বাস্তবতা হলো, প্রায় প্রতিদিনই দেওয়ানী মামলায় এডিআর শুনানির সময় পক্ষগণ অনুপস্থিত থাকেন।
২. আপোষে সমাধানের বাস্তব সম্ভাবনা—কিন্তু পক্ষগণ অজ্ঞ
বিচারিক অভিজ্ঞতায় দেখেছি—বহু দেওয়ানি মামলা শুধুমাত্র হয়রানির উদ্দেশ্যে দায়ের করা হয়। প্রকৃত মালিককে বছরের পর বছর কোর্টে টেনে আনা হয়। অথচ একটি আন্তরিক উদ্যোগে, দক্ষ ও নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর সহায়তায় এক বৈঠকেই এমন অন্তত ২০% মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। কিন্তু পক্ষগণ জানেন না—আজই হয়তো তাদের মামলা শেষ হয়ে যেতে পারতো।
৩. বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার মূল—আইনী সুযোগের অপব্যবহার
আদালত বহু বছর ধরে শুনানি নিয়ে রায় দেয়। এরপর আসে আপিল, রিভিশন, হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ—একে একে বছরের পর বছর চলে যায়। অর্থবিত্ত ও কৌশলের সহায়তায় পক্ষগণ বারবার মামলাকে বিলম্বিত করার সুযোগ খুঁজে নেয়। এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে না আনলে ‘দ্রুত বিচার’ শুধু আশাই থেকে যাবে।
৪. রাঙামাটিতে সফল প্রাক-বিচার আপোষের কার্যকর মডেল
রাঙামাটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে দায়িত্ব পালনকালে আমরা দেখেছি—সুশৃঙ্খল ও সৎভাবে পরিচালিত প্রাক-বিচার আপোষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৩০-৪০% বিরোধ আদালতে গড়ানোর আগেই নিষ্পত্তি সম্ভব। এর ৭০% ছিল দেওয়ানি প্রকৃতির বিরোধ। এটি একটি কার্যকর বিকল্প, যেখানে জনগণ সময়, অর্থ ও হয়রানি থেকে রেহাই পেয়েছে এবং দ্রুত ন্যায়বিচার লাভ করেছে।
সারসংক্ষেপে যুক্তি:
১. বিদ্যমান আইন থাকলেও দেওয়ানি মামলায় আপোষের প্রয়াস কার্যত অকার্যকর।
২. আপোষ শুনানিতে অনুপস্থিতি বিচার বিলম্বের অন্যতম কারণ।
৩. আইনের অপব্যবহার রোধ করতে হলে প্রাক-বিচার আপোষ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. মাঠপর্যায়ে আপোষের সফল বাস্তব উদাহরণ রয়েছে, যা অনুকরণযোগ্য।
উপসংহার
বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে জটিল ও সময়সাপেক্ষ সিভিল মামলাগুলো শুরুর আগেই বাধ্যতামূলকভাবে আপোষ প্রচেষ্টা গ্রহণের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। “লিগ্যাল এইড আইন ২০২৫” এর সংশোধনী সেই সময়োপযোগী পদক্ষেপ, যা জনগণকে দ্রুত, সহজ ও সাশ্রয়ী ন্যায়বিচারের পথে নিয়ে যেতে পারে।
বিচার নয়—ন্যায়বিচারই কাম্য। আর যদি সেটি দ্রুত ও কম খরচে পাওয়া সম্ভব হয়, তবে কেন আমরা সেটিকে বাধ্যতামূলক করবো না?
মোঃ জুনাইদ
সিনিয়র সহকারী জজ, সুনামগঞ্জ।
সাবেক জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।