তারাকান্দা থেকেঃ ভুলে যাওয়া আমাদের চরিত্রেরই অংশ ৷ আর এই অংশ হিসাবেই আমরা অনেক কিছু ভুলে যাই। আবার অনেক কিছু ইচ্ছা করেই ভুলে যেতে চেষ্টা করি। কিন্তু ইতিহাসকে কি আমরা ইচ্ছা করলেই ভুলে যেতে পারি কিংবা আচ্ছাদন আড়াল দিয়ে তাকে ঢেকে দিতে পারব?
আজ আমাদের রাংসাতীরবর্তী জনপদের একজন মহানায়কের ইতিহাস সম্পর্কে কিংশুক আলোকপাত করতে চাই।
এই জনপদের একটি স্বাতী নক্ষত্রের নাম এম.শামসুল হক ,যার আলো সর্বদাই আমাদের হৃদয়ের উপর ফেলে তার প্রাণময় ছায়া। ওনার মৃত্যু যেন এক স্থানান্তর মাত্র, ভিন্নতর রুপ নিয়ে তিনি সর্বদা বিরাজমান আমাদের এই মাটিও মানুষের হৃদয়ের দেবালয়ে ,সময়ও তাহার সুকর্মের গৌরব কখনো আড়াল করতে চায়নি কোন দিন ,হয়ত চেষ্টা করলেও পারবেনা।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে এক কিংবদন্তীতুল্য কালপুরুষ এম.শামসুল হক এম.পি মহোদয় , ওনার পদচিহ্ন গুলো নদীর মতন ,দুকুল প্লাবণ করে ফুলপুর-তারাকান্দার এই জনপদকে সবুজে ভরে তোলার জন্য সংগ্রাম করেছেন সারা জীবন। সরল্য আর নিরঅহংকারী এই মানুষটি এই লোকালয়ের মানুষের নিকট ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের মতন , ওনার প্রাণময় ডালপালা বন্ধুকে যেমন শীতল ছায়া দিতেন তেমনি শত্রুকেও দিতেন পরম মমতা -ভালোবাসা। যার জন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষের নিকট ছিলেন তিনি আদর্শরুপে।
ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে বসেও তিনি ভোগের জীবন পরিহার করে একতলার ভাঙ্গাবাড়ি আর ভাঙ্গা গাড়ি চড়েই সুখীজীবনকাল পার করেছেন।তাহার যাপিত জীবনকাল ব্যাপ্ত অকৃত্রিম ভালোবাসা আর অনড়ম্বর সরল্যে প্রবাহমানতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্তে মুখর। সমস্ত জীবন জুড়েই ছিল নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়ণ সাধনায় ধ্যানে নিমজ্জিত।
তাকে ইতিহাস উপেক্ষা করবে কিভাবে বলুন?
আজ একুশের প্রথম প্রহরে এই মহান ব্যক্তির কর্মের চিত্র নতুনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে , শোভিত হয়েছে একটি অপ্রস্ফুটিত কলি পাপড়ি মেলে দিয়েছে ৷
অন্তরভেদী অবলোকনে এই কলি মঞ্জুরীর জন্য অপেক্ষারত ছিল আমাদের চোখে।আজ অনুভব আর স্বপ্নের সিঁড়ি ভেঙ্গে ,আমাদের আরাধ্য সে কুসুম পাপড়ি মেলে দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে সৌরভ। মিলন মাধুরীর এই দৃশ্য আমার চোখে আজ ভীষন উপভোগ্য ৷ আজ আমার আত্নশক্তি আর দৃষ্টিশক্তি প্রখরতায় উজ্জ্বল ,আজ রক্তে উত্তাল অস্তিত্ব ৷আজ এই জনপদের ইতিহাসে একটি সমুজ্জ্বল দিন।
প্রশ্চাৎপটে যদি আজ ফিরে তাকাই-নিখাদ দেশপ্রেমে অঙ্গীকৃত এই মহান নেতা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ছিলেন আনন্দ মোহন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের একজন ছাত্র।রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা যখন উত্তাল ,রাজধানীর এই রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমন্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলা শহরে , সেই আন্দোলনকে ময়মনসিংহ জেলায় সক্রিয় ও বেগবান করার লক্ষ্যে তিনি সেই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
আর এই আন্দোলনে অন্যতম সক্রিয় মূখ্য ভূমিকা রাখায় ১৯৫২ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ৬ মাস কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে তাকে বন্ধি করে রাখা হয়। তবুও তিনি দমে যাননি, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ময়মনসিংহ শহরে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তার এই ভাষা আন্দোলনে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এবছর এই মহান ব্যক্তিকে মরনোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে তার অবদানের এই স্বীকৃতি দীর্ঘ দিন পর হলেও তা আমাদের জন্য এক অনন্য গৌরব ও আত্ন তৃপ্তির বিষয়।
মরহুম এম.শামসুল হক ১৯৩০ সালে ২১ জানুয়ারী ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার কামারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাহার পিতা এডভোকেট সমীর উদ্দিন ছিলেন একজন নামকরা আইনজীবি ৷
ভাষা সৈনিক এম.শামসুল হক ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ৫২ এর ভাষা আন্দোলন ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ সহ তৎকালীন সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের ১ম জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে তৎকালীন ময়মনসিংহ ১৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।১৯৮৬ সালে ৩য় ১৯৯১ সালে ৫ম ১৯৯৬ সালে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে ময়মনসিংহ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।১৯৮৮ সালে তিনি ফুলপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হন।
তিনি১৯৯৬ সালে বস্রও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। তৃণমূল থেকে উঠে আসা ব্যাপক জনপ্রিয় এই নেতার স্থানীয় জনগনের প্রতি ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ,তাছাড়াও অবিসংবাদিত এই নেতা বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন। এবং আওয়ামী লীগের সকল আন্দোলন সংগ্রামে সন্মুখ সারির একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
সাধারন মানুষকে সহজেই আপন করে নেয়ার এক আশ্চর্য্য মোহনী ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে I তার স্ত্রী আম্বিয়া খানম একজন গৃহিনী হওয়া সত্ত্বেও তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ছিল প্রেরনার উৎস।
ব্যক্তি জীবনে ৩ পূত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা তিনি। তাহার সুযোগ্য পূত্র শরীফ আহম্মেদ ময়মনসিংহ-০২ সংসদীয় আসনে২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালের মন্ত্রীসভায় শরীফ আহম্মেদকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়৷বর্তমানে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৩ সালে তারাকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবেও কিছুদিন তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৫ সালে ২৭ মে হৃদযেন্ত্রর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ভাষা সৈনিক এম. শামসুল হক পরলোক গমন করেন। তাহার কীর্তিকে স্নরন করে রাখার জন্য ময়মনসিংহ টাউন হল সংলগ্ন স্থানে ভাষা সৈনিক এম .শামসুল হল মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে ,
আজীবন সংগ্রামী এবং অধিকার আদায়ে আপোষহীন এই জননেতার বিদেহী আত্মার প্রতি একুশের এই প্রথম প্রহরে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও তাকে একুশে পদকে ভূষিত করায় ফুলপুর ও তারাকান্দা বাসীর ও জনাব শরীফ আহম্মেদ এম.পি মহোদয়ের পক্ষ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।