চরে যোগাযোগের সম্বল যখন ঘোড়ার গাড়ি

চরে যোগাযোগের সম্বল যখন ঘোড়ার গাড়ি

রূপান্তর বাংলা ডেক্স : গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চল। রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। দুর্গম এ চরাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা আর শুকনো মৌসুমে চরাঞ্চলের মালামাল বহনের একমাত্র ভরসা ঘোড়ার গাড়ি। আর এ গাড়ি চালিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার।

পানি কমে যাওয়ায় বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র এখন মরুভূমিসম। এতে উপজেলার সাতারকান্দি, রসুলপুর, খাটিয়ামারি, ফুলছড়ি, টেংরাকান্দি, বাজে ফুলছড়িসহ চরের প্রায় ৫০টি গ্রামবাসীর লোকজন যাতায়াত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল ঘোড়ার গাড়িযোগে বহন করছেন। এতে একদিকে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হয়েছে, অন্যদিকে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা এসেছে পরিবারগুলোতে।

ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর কারণে একবারে বিচ্ছিন্ন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি, ফুলছড়ি ও গজারিয়া ইউনিয়ন। এসব ইউনিয়নের খাটিয়ামারি, জিগাবাড়ি, পেপুলিয়া, গাবগাছি, গলনা, জিয়াডাঙ্গা, সাতারকান্দি, রসুলপুর, খাটিয়ামারি, ফুলছড়ি, টেংরাকান্দি, বাজে ফুলছড়িসহ প্রায় ৫০টি এলাকায় কোনো যানবাহন চলাচলের উপায় না থাকায় চরের মানুষজন বালুময় পথে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। এমনকি তাদের উৎপাদিত পণ্য মাথায় করে আনা-নেওয়া করতে হত। এখন চরাঞ্চলের মানুষের মালামালের বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়িই একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চরাঞ্চলের চাষীদের উৎপাদিত ফসলও জমি থেকে তুলে বাড়ি নেওয়া ও উপজেলা সদরে বিক্রির জন্য নদীর ঘাটে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভরসা ঘোড়ার গাড়ি।

রাস্তাঘাট না থাকায় চলাঞ্চলের অধিকাংশ ঘোড়ার গাড়ির চালকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছুটে বেড়াচ্ছে এ চর থেকে ওই চরে।

ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের রসুলপুর চরের এক ঘোড়ার গাড়ির চালক আব্দুল রইফ মিয়া (৩৫) বলেন, আমরা গরিব মানুষ, কাম না করলে খাবো কী? একবেলা কাম করলে আরেকবেলা কাম করতে পারি না। সংসার চালানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়াই ঘোড়ার গাড়ি চালাই। দৈনিক ৭০০-৮০০ টাকা উপার্জন করি। ঘোড়ার খাবারের জন্য প্রতিদিন ব্যয় করতে হয় ২০০-২৫০ টাকা। বাকি টাকায় চলে সংসার।

তিনি আরও বলেন, দুই বছর আগেও এই চরাঞ্চলে ১৫-২০টা ঘোড়ার গাড়ি ছিল। আর এখন এই ইউনিয়নে ৩০-৪০টা ঘোড়ার গাড়ি হয়েছে। দিন দিন ঘোড়াগাড়ির চাহিদা বাড়ছে।

ফুলছড়ি উপজেলার পেপুলিয়া এলাকার ঘোড়ার গাড়ির চালক আব্দুস সালাম বলেন, দুই বছর ধরে ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছি। দিনে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা কামাই হয়। তা দিয়ে সংসার ভালোই চলছে। শুকনো মৌসুমে আয়ের পরিমান আরও বাড়ে।

সাতারকান্দি চরের আবুল শেখ বলেন, শুকনো মৌসুমে চরাঞ্চলের মানুষ ও প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের একমাত্র ভরসা ঘোড়ার গাড়ি। চরের বাদাম, ভুট্টা, মসুর ডাল, বোরো ধান, মিষ্টি আলুসহ বিভিন্ন পণ্য ঘোড়ার গাড়িতে বহন করে বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফুলছড়ি উপজেলার টেংরাকান্দি গ্রামের চালক আনারুল ইসলাম জানান, এখানে প্রায় ১০০টি ঘোড়ার গাড়ি যাতায়াত করে। টেংরাকান্দি থেকে ফজলুপুর, বাঘবাড়ি, তিস্তামুখঘাটসহ চরের বিভিন্ন এলাকায় মালপত্র পরিবহন করা হয়। একেকটি ঘোড়ার জন্য প্রতিদিন ১২০ টাকার মতো খাবার (ভূষি ও গুড়া) খাওয়াতে হয়।

গজারিয়া ইউনিয়নের কৃষক হাফিজুর রহমান বলেন, আগে মাথায় করে কৃষিপণ্য হাট-বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতাম। কিন্ত এখন ঘোড়ার গাড়ি হওয়ায় খুব সহজে মালামাল পরিবহন করা যায়। এক মণ ভুট্টা বা ধান বহন করতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা ভাড়া দিয়ে মালামাল গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া যায়।

উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হানিফ প্রামানিক বলেন, নদী ভাঙনের এলাকার যতো মালামাল সব পরিবহন করা হয় ঘোড়ার গাড়িতে। ফজলুপুর, ফুলছড়ি ও এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪ শতাধিক ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করছে। আমার ফুলছড়িতেই প্রায় দেড় থেকে দুইশ গাড়ি রয়েছে। এদের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দরকার।