দেওয়ানগঞ্জ আলোকিত শিক্ষক আশরাফ হোসেন

বোরহান উদ্দিন দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধিঃ  জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চর আমখাওয়া ইউনিয়নের এক অবসরপ্রাপ্ত  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফ হোসেন যার স্কুল জীবন ছিল নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ।  ব্রম্মপুত্র, যমুনা, জিঞ্জিরাম নদীর  আগ্রাসনে  গ্রাম গেছে, বাড়ি গেছে কিন্তু পড়াশোনা টা ততোধিক না করতে পারলেও স্বাধীনতার পূর্বেই ১৯৬৯ সালে স্ব- উদ্যোগে গড়ে তোলেন  একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার স্বপ্ন ছিল অজপাড়াগাঁয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। সেই থেকে শুরু  একে একে চরাঞ্চলের আরও কিছু বিদ্যোৎসাহী মানুষদের সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন  মিতালি উচ্চ বিদ্যালয়, বাউলপাড়া, মিয়াপাড়া, হোসেনপুর সহ বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় যার সবকটি এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
তিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পেশা হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকেই বেছে নেন যদিও স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবেও  অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। শিক্ষকতা জীবনের  দীর্ঘ সময়ে  তিনি কখনো লজিং থেকেছেন, কখনো নদী সাঁতরে, কখনো বাইসাইকেল বা পায়ে হেঁটে স্কুলে গিয়েছেন, কিন্তু কখনো দায়িত্বে অবহেলা করেননি। নিজ আলোয় মফস্বলের প্রত্যন্ত অঞ্চলকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার চেষ্টা ছিল তাঁর নেশা।
 অন্যদের আলোকিত মানুষ হিসেবে ঘড়ে তুলার পাশাপাশি নিজ সন্তানদের  সবাইকে সুশিক্ষিত করার জায়গায় তিনি বড় সাফল্যের একজন মানুষ। দুই ছেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিন মেয়ে  সরকারি চাকুরীজীবী। বড় ছেলে – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক,  তার সহধর্মিণী চক্ষু বিশেষজ্ঞ যিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মরত, বিসিএস ক্যাডার।
আরেক ছেলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, তার সহধর্মিণীও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফির সহকারী অধ্যাপক।
তিনি এখন দেওয়ানগঞ্জ- বকশিগঞ্জ – রাজিবপুর – রৌমারী অঞ্চলের মানুষের অনুকরনীয় এক ব্যক্তিত্ব ।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নাসির কোম্পানী কমান্ডে যোগদান করে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অফিসিয়াল  কাজ কর্ম শুরু করেন । অবসর সময়ে রণাঙ্গনের  দেশের গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং তাদের কাজে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। নিজে  মুক্তিযুদ্ধের  সনদ গ্রহণ করেননি তার  আরও দুই ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
 আশরাফ হোসেন  ৮০-৯০ দশকে পল্লীর নিভৃত অঞ্চলে বাৎসরিক নাটক উৎসব, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদি আয়োজন করতেন, পরিচালনা করতেন। লংকার চরে তার অনুপ্রেরণায় ঘড়ে তুলেছিলেন এক পাঠা্গাড়  ।
ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার বা সফলতার বাইরে সামাজিক সকল কাজে সবসময়ই তিনি সহযোগিতা পেয়েছেন সমকালীন বা সিনিয়র আরও কিছু গুণী মানুষদের।  আবু সাইদ মাস্টার, সাজির উদ্দিন মাস্টার, হাবিবুর রহমান মাস্টার, আব্দুল গণি মাস্টার, জয়নাল আবেদীন মাস্টার, ওহেদুজ্জামান ডাঃ প্রমুখ  – তাঁদের অকৃত্রিম সহযোগিতায় এলাকায় শিক্ষার আলো আজ জ্বলজ্বলে।
একজন আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে নিজেকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাই নয় আলোকিত করেছেন তার পুরা একটা দুর্গম চরাঞ্চলকে । আশরাফ হোসেনের পরিবারকে অনুসরন করে অনেকেই স্বপ্ন দেখছেন বড় এবং ভাল মানুষ হওয়ার ।
তাঁর বড় ছেলে  ডাঃ আব্দুল্যাহ আল মাসুম,  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের  সহকারি অধ্যাপক, পাশাপাশি তিনি সংস্কৃতিমনা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং বিএমএ’র সাবেক কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিও ছিলেন। দেওয়ানগঞ্জ বকশিগঞ্জ উপজেলা তথা জামালপুর জেলার সকল মানুষের জন্য চিকিৎসা বিষয়ে তিনি সাধ্যমতো সহযোগীতা করে চলছেন প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে । তিনি জামালপুর -১ আসনের  এমপি,  আবুল কালাম আজাদ সাহেবের ব্যাক্তিগত চিকিৎসকও বলতে গেলে। ইতোমধ্যে ডা. আব্দুল্যাহ আল মাসুম এর দুটো কবিতার বই এবং দশটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্র দেশী বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ছোট ছেলে আব্দুল্যাহ আল মারুফ (মনির) রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের  সহযোগী অধ্যাপক। জার্মানির কোলন ইউনিভার্সিটি হতে পিএইচডি সম্পন্ন করে আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। তার স্ত্রী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের  সহকারি অধ্যাপক।
মিতালি গ্রাম- যেই গ্রামে কিছুদিন আগেও বিদ্যুৎ এর আলো পৌছেনি, সেখানে বিদ্যুৎতের আলো পৌঁছাতে এই পরিবারের বড় অবদান আছে বলে অনেকে  স্বীকার করেন ।
যেখানে  শিক্ষার আলো ছিল নিভু নিভু সেই গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে সততার সাথে জীবন পরিচালিত করে দুই ছেলেকে  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানিয়েছেন আশরাফ হোসেন  । কি মন্ত্র ছিল এর পিছনে জানতে চাইলে আশরাফ হোসেন জানান  জীবনে আমি খুব কষ্ট করেছি সামান্য প্রাইমারি স্কুলের চাকুরী করে ৫ সন্তানকে মানুষ করেছি । আমি জমি জমা করিনি সম্পদ করিনি ছেলেমেয়ে দের শিক্ষিত করেছি যেন এরাই আমার সম্পদ হয় ।
ছোটবেলায় সন্তানদের আদর্শবান হিসেবে বড় করেছি তাদের আদর শাসন এই দুই মিলে বড় করেছি । আমি সবার কাছে অনুরোধ করি যেন ছেলেমেয়ে দের লাগাম  ছেড়ে না দেয় চোখের নজরে রেখে মানুষ করে ।
আশরাফ হোসেনের বড় ছেলে চিকিৎসক ডাঃ আব্দুল্যাহ আল মাসুম জানান বাবাই আমাদের অনুপ্রেরণা তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা বড় হয়েছি। সময়ের কাজ সময়ে করার তাগাদা এবং বিশেষ কিছু হওয়ার একটা তাগাদা ছিল বাবর পক্ষ হতে সবসময়ই। বেশির ভাগ সময়ই দেখতাম বেতনের পুরোটাই আমাকে দিয়ে, আব্বা খালি হাতে বাড়ি যাচ্ছেন এবং আমাকে হাসিমুখে ট্রেনে উঠিয়ে দিচ্ছেন – যা আমাকে বিরাট শক্তি দিতো পড়াশোনার আউটপুট বিষয়ে। সহজ, সরল, ভাল মানুষ হতে হবে এই তাগিদ অনুভব করেছি পিতার চলাচলের পথ দেখেই।
ডা. মাসুমের স্বপ্ন অবহেলিত জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, বকশিগঞ্জ, রৌমারী, রাজিবপুর – সীমান্তবর্তী এসব এলাকায় স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার সমৃদ্ধি নিয়ে কাজ করা, সকলের সহযোগিতায় পেলে অচিরেই কার্যক্রম শুরু করবেন তিনি।