স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর থেকে ফরহাদ আলমঃ ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৯৯৫ সালের ২৩শে আগস্ট দিবাগত রাতে। অর্থাৎ আজকের এই রাতেই ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি বাসে করে দিনাজপুরের দশমাইল মোড় এলাকায় ঠাকুরগাঁও গামী এক বাস থেকে নামে ইয়াসমিন আক্তার নামের এক কিশোরী। তার বয়স ছিলো আনুমানিক ১৪ বছর।
ইয়াসমিন আক্তার ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতেন।
সেদিন ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁগামী একটি বাসে চড়ে দিনাজপুরের বাড়িতে আসতেছিলেন তিনি। দিনাজপুরের যাত্রী হওয়ার কারনে ঠাকুরগাঁওগামী বাসটি দিনাজপুরের দশমাইল মোড় এলাকায় একটি পানের দোকানের সামনে নামিয়ে দিয়েছিলো। বাস থেকে নেমে সেই কিশোরী অপেক্ষা করছিলেন দিনাজপুরগামী যানবাহনের জন্য। সে সময় টহল পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান সেখানে হাজির হয়। স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি মেয়েটিকে পরামর্শ দেয় যে পুলিশের গাড়িতে করে দিনাজপুর শহরে যেতে। কিন্তু পুলিশের ভ্যানে করে সেই কিশোরী দিনাজপুর শহরে যেতে রাজী ছিলেন না। তখন পুলিশ সদস্যরা বলেন যে এতো রাতে তার সেখানে একা থাকার অন্য কোনো কারন আছে কিনা? এইরুপ নেগেটিভ প্রশ্নের সন্মুখ্খীন হতে হবে তাই পুলিশের বাহনকে নিরাপদ ভেবে অনিচ্ছাসত্ত্বে ও পুলিশের সেই পিকআপ ভ্যানে উঠেছিলেন । ভ্যানে ছিলেন একজন এএসআই এবং দুইজন কনস্টেবল। পর দিন সকালে কিশোরীটির মৃতদেহ পাওয়া পাওয়া যায় গোবিন্দপুর নামক জায়গায়।
এ খবর ছড়িয়ে গেলে ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দিনাজপুর।
এ ঘটনা নিয়ে স্হানীয়ভাবে বিভিন্ন সংগঠন বিচারের দাবিতে নানা প্রতিবাদ করতে থাকে।
বিভিন্ন সরকারি অফিসে ভাংচুর চালিয়ে তছনছ করা হয়। দিনাজপুর শহরে কাস্টমস গুদামে মালামাল লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসেও আক্রমণ করা হয়। পরিস্থিতি এতোটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে দিনাজপুর শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিডিআর মোতায়েন করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে দিনাজপুর শহরে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু এই কারফিউকে আমলে নেয়নি সাধারণ মানুষ। কারফিউ উপেক্ষা করেই বিভিন্ন জায়গায় মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
একপর্যায়ে ঘটনার দুইদিন পরে এলাকাবাসী কোতোয়ালী থানা আক্রমণ করে সারারাত থানা অবরুদ্ধ করে রাখে। সে সময় কোন পুলিশ সদস্য থানা থেকে বের হতে পারেনি। পরের দিন দিনাজপুর শহরে শতশত মানুষ বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এসময় কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভের মাত্রা এতোটাই তীব্র হয়েছিলো যে পুলিশ মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও করে এবং তাতে সামু, কাদের, সিরাজ সহ সাতজন নিহত হয়।
নিহত ইয়াসমিন আক্তারের গায়েবানা জানাজায় হাজার-হাজার মানুষ অংশ নেয়। সাধারণ মানুষের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের প্রশাসন কার্য্যত অচল হয়ে পড়েছিল। পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ এতোটাই চরমে ওঠেছিলো যে পুলিশ সদস্যরা রীতিমতো লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিলো। উনিশশো পঁচানব্বই সালের ২৯শে অাগস্ট দিনাজপুর থেকে ভোরের কাগজ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সে প্রতিবেদনে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে বর্ণনা করা হয় এভাবে – “গোটা শহরটাই যেন প্রেতপুরী। সব পুলিশ কোথায় যেন গা ঢাকা দিয়েছে। আজ শহরে একটি রিকশায় কিছু আসবাবপত্র পরিবহন করতে দেখলে এক পথচারী জানতে চায়, ‘এসব কার মাল?’ রিকশাচালক উত্তর দেয়, এগুলো পুলিশের না। শহরবাসী আর পুলিশকে বাসা ভাড়া দিবে না।”দিনাজপুর শহরে কর্মরত পুলিশ সদস্যরাও রাস্তায় নামেনি। পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এতোটাই চরমে উঠেছিল যে উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা বিডিআর পাহারার মধ্য দিয়ে দিনাজপুরে শহরে প্রবেশ করেন। পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারী নিহতের সংখ্যা অন্তত সাতজন বলা হলেও তৎকালীন সরকার দাবি করে নিহতের সংখ্যা তিনজন।অভিযোগ ওঠে তথ্য গোপনের জন্য পুলিশের গুলিতে নিহত কয়েকজনকে দ্রুত কবর দেয়া হয়। নিহতদের রক্তমাখা জামা এবং মরদেহ শহরের একটি কবরস্থানে রয়েছে বলে খোঁজ পায় কিছু এলাকাবাসী। সেখানে মরদেহ দেখে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরো ফুঁসে উঠে। পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সামাল দিতে দিনাজপুর জেলার পুলিশ সুপারকে বদলি করা হয়। একই সাথে দিনাজপুর জেলা থেকে ১০৫ জন পুলিশের কর্মকর্তা এবং সদস্যকে বদলি করে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে সে সময় সরকারের তরফ থেকে একটি প্রেসনোট প্রচার করে পুলিশ সদস্যদের রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। উল্টো ঘটনার দায় নিহত ইয়াসমিন আক্তারের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। প্রেসনোটের ভাষ্য ছিল, “উপস্থিত লোকজনের অনুরোধে, টহল পুলিশের টিম মেয়েটিকে দিনাজপুর শহরে পৌঁছানোর জন্য গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। দিনাজপুরে আসার পথে মেয়েটি হঠাৎ করে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পড়ে যায় এবং জখমপ্রাপ্ত হয়। পুলিশ গাড়ি থামিয়ে মেয়েটিকে ওঠায়। দিনাজপুরে নেয়ার পথে মেয়েটি মারা যায়। তখন পুলিশ দিনাজপুর শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক অফিসের কাছে রাস্তার পাশে মৃতদেহ রেখে থানায় গিয়ে খবর দেয় ।
মানুষের ক্ষোভ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবং থানা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু কর্মকর্তা শহরে প্রকাশ্যে আসেননি।” পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটানা ৩৮ ঘণ্টা কারফিউ জারি রাখা হয়। কিন্তু তাতে বিক্ষুব্ধ মানুষ দমে যায়নি। এক পর্যায়ে অভিযুক্ত তিনজন পুলিশ সদস্যকে আটক করে রাখা হয়। পরিস্থিতি শান্ত করে প্রশাসনের তরফ থেকে শহরে মাইকিং করে জানানো হয়েছিল যে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনার চারদিন পরে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর সফরে আসেন। তিনি বলেন, “খালেদার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এবার ক্ষমতা ছেড়ে যেতে হবে।”
প্রবল বিক্ষোভের মুখে ঘটনার পাঁচদিন পরে ময়নাতদন্ত এবং সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির জন্য ইয়াসমিনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। ময়নাতদন্তের পর অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। বিচারের মাধ্যমে তারা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলো। ঘটনার নয় বছর পর অর্থাৎ ২০০৪ সালে তিন জন পুলিশ সদস্য ( এ এস আই মঈনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ চালক অম্রিতলাল বর্মণ ) কে ফাঁসি দেয়া হয়।
ওই ঘটনার পর থেকে ২৪ আগষ্ট নানা আয়োজনে এই দিনটি “জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস “হিসেবে পালন করা হয়।