বগুড়ায় ‘আরডিএ’র প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা লুটপাট

আমিনুল ইসলাম, বগুড়া থেকেঃ বগুড়ার ৩০ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার টাকার প্রকল্পের অধিকাংশ ক্ষেত্রে শতভাগ ব্যয় দেখানো হলেও কোনো কাজ হয়নি। লুটপাট করা হয়েছে হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা। সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক মনিটরিং প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা যুমনা নদীর গা ঘেঁষে পশ্চিম পাশে লেগে আছে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই নদী ভাঙনের শিকার। তাদের (হতদরিদ্র) সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পারিবারিক আয়বৃদ্ধি, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য ‘বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার চর এলাকায় বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প তৈরি করা হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হয় বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমীকে।

এই প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) আরডিএর প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক ড. সমীর কুমার সরকার। উপ-প্রকল্প পরিচালক ছিলেন একই প্রতিষ্ঠানে উপপরিচালক মো. মহিউদ্দিন। প্রকল্প শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ জুনে। শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের জুনের মধ্যে। তবে এই সময়ে শেষ না হওয়ার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন করা হয়।

কাজ না করেই এই প্রকল্পের টাকা তছরুপের বিষয়টি ধরা পরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং রিপোর্টে। এই প্রকল্প মনিটরিং করেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হামিদুর রহমান। এই প্রকল্পের টাকা লুটপাটের বিষয়টি মনিটরিং করে গত ৩ ডিসেম্বর তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। সেই প্রতিবেদনে কোটি কোটি টাকা লুটপাতের চিত্র উঠে আসে।

গরু ও ছাগল বিতরণঃ

প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুযায়ী গত জুনের মধ্যে ৬ হাজার পরিবারকে ৩ হাজার গরু ও ৩ হাজার ছাগল দেওয়ার কথা। এ খাতে ব্যয় নির্ধারণ ছিল ৮ কোটি ১০ লাখ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৯১২ টি গরু ও ২ হাজার ৯৩১টি ছাগল বিতরণ করা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় করা হয়েছে ৭ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

স্টাইপেন্ড প্রদানঃ

ডিপিপি অনুযায়ী ৩ হাজার গরু ও ৩ হাজার ছাগলের চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তায় স্টাইপেন্ড দেওয়ার জন্য ৩ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার বরাদ্দ করা হয়। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা গরু ও ছাগলের চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তায় স্টাইপেন্ড দেওয়ার জন্য ২ কোটি ৮৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা নির্ধারণ ছিল। কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে ২ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা। এ কাজটি সেলফোনভিত্তিক লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের সাথে প্রকল্প দপ্তরের সমঝোতা চুক্তি হয়। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুফলভোগীদের বিকাশ নাম্বার (সেলফোন) ১ কোটি ৬২ লক্ষ ২৫ হাজার ৫৪০ টাকা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এ খাতে এক কোটি ১৫ হাজার টাকা গায়েব করা হয়েছে।

প্রশিক্ষণঃ

ডিপিপি মতে এ প্রকল্পে ১২ হাজার ২২০ জন সুফলভোগীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রশিক্ষণের জন্য ২ কোটি ৬৭ লাখ ২৬ হাজার (বরাদ্দের ৮৮.৯৩%) টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অথচ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মাত্র ৪৫০ জন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ সুফলভোগীকে প্রশিক্ষণে বরাদ্দের প্রায় ৮৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে। এমনকি প্রশিক্ষণে ডিপিপির নির্দেশনাও মানা হয়নি।

কৃত্রিম প্রজননঃ

প্রকল্পে দুটি কৃত্রিম প্রজনন ইউনিট করার বিধান রয়েছে। এ খাতে ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। অক্টোবর পর্যন্ত ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। বরাদ্দের ৮৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে ৪০ শতাংশেরও কম কাজ করা হয়েছে। এ খাতে কাজের ক্ষেত্রে নির্দেশনা মানা হয়নি। কেবল তাই নয়, অধিকাংশ কাজ না করেই ব্যয় দেখানো হয়েছে।

স্যাটেলাইট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রঃ

স্যাটেলাইট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাস্তবে এ খাতের শতভাগ টাকা খরচ করা হলেও কোন ক্লিনিক (স্যাটেলাইট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র) স্থাপন করা হয়নি।

গো-খাদ্য তৈরি সহায়তাঃ

এ খাতে ৩০টি সাইলেজ চপিং মেশিন, ৮ টি নছিমন (চরের গাড়ি), ৩০০ পরিবারে অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহের জন্য ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ খাতেও শতভাগ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু কোন নছিমন অথবা সাইলেজ চপিং মেশিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

গরু মোটাতাজাকরণ ও উদ্যোক্তা তৈরিঃ

এ খাতে ৭৫০ টি ফিডিং সিস্টেমসহ গরুর শেড নির্মাণের জন্য ৫৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা ও ৭৫০ পরিবারকে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য ৪ মাসব্যাপী সাপ্লিমেন্টারি খাবার সরবরাহের জন্য ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। গরু মোটাতাজাকরণ ও উদ্যোক্তা তৈরিতে শতভাগ ব্যয় দেখানো হয়েছে। তবে এ খাতে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।

দুগ্ধ বাজারজাতকরণঃ

দুগ্ধ বাজারজাতকরণ ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য ৮ টি ইউনিট স্থাপনের কথা থাকলেও মাত্র দুটি স্থাপিত হয়েছে। এ দুটিও বর্তমানে অকার্যকর। অথচ এ খাতে শতভাগ ব্যয় করা হয়েছে। অর্থাৎ ১ কোটি ৫৫ লাখ ৫৭ টাকাই ব্যয় করা হয়েছে।

হস্তচালিত অগভীর নলকূপঃ

সুফলভোগী ৩০০ পরিবারকে হস্তচালিত অগভীর নলকূপ সরবরাহের জন্য ৬২ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। নথিতে এ খাতে শতভাগ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ খাতের কোন নলকূপ সরবরাহ করা হয়নি।

পানি সরবরাহঃ

প্রকল্প এলাকায় পল্লী অঞ্চলে সোলার সিস্টেম ও বারিড পাইপের মাধ্যমে ১ হাজার ২০০ পরিবারে পানি সরবরাহ করার কথা। এ খাতে ব্যয় নির্ধারণ রয়েছে ২ কোটি ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। প্রকল্প এলাকায় পানির ট্যাংক, গভীর নলকূপ, ২ টি সোলারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত এ খানে ২ কোটি ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অর্থাৎ বরাদ্দের ৯৯ দশমিক ৮০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এটিও ঠিকাদারের উল্লেখকৃত মূল্যের তুলনায় ২০ লাখ ৫ হাজার টাকার বেশি।

স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানাঃ

১ হাজার ৫০০ পরিবারকে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা বিতরণের বিপরীতে (প্রতিটির জন্য ৯ হাজার ৩৯০ টাকা) ১ কোটি ৪০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ খাতে বরাদ্দের শতভাগ খরচ করা হলেও কেবল ৪৮৯ পরিবারকে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা সরবরাহ করা হয়েছে।